২০২১ সালে খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যাত্রার শুরুর পর থেকে উপাচার্য হিসাবে আছেন অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান। গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এবং শেখ পরিবারের খুবই আস্থাভাজন হওয়ায় শেখ হাসিনার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরু থেকেই তিনি খুলনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেলসহ আওয়ামী পরিবারের পূর্ণ সহযোগী হয়ে একের পর এক অপকর্ম করেছেন। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আলী আকবর টিপু ছিলেন উপাচার্যের নিকটতম আত্মীয়। তার সাথে মিলেই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন ভিসি মোঃ মাহবুবুর রহমান।
গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ উপাচার্য পদত্যাগ করলেও সেসময় এই ভিসি বহাল তবিয়তেই ছিলেন। ইতোমধ্যে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পর্রিবর্তন হলেও কোন এক অদৃশ্য জাদুবলে মোঃ মাহবুবুর রহমান টিকে যান!
আগামী ৩ মে তার মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পদে আরো একবার আওয়ামী পরিবারের এক সদস্যকে উচ্চতর পদের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের পায়তারা করে কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী পরিবারের জাকিয়া সুলতানা (বর্তমানে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা) কে যোগ্যতা ছাড়াই উচ্চতর পদে নিয়োগের জন্য আইন-বিধির কোন তোয়াক্কা না করেই একের পর বেআইনী কাজ করে চলেছেন।
ভিসি তার মেয়াদ শেষের আগেই জাকিয়া সুলতানাকে সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদে নিয়োগ দিয়ে যাওয়ার জন্য ০৯ মার্চ তারিখে তড়িঘড়িপূর্বক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে একাধিকবার আইন ভঙ্গ করেছেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে আবেদনের জন্য ন্যূনতম ২১ দিন সময় প্রদানের কথা থাকলেও সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৩ দিন (০৯ মার্চ থেকে ২২ মার্চ) যার মধ্যে ছুটিই ছিল ৪ দিন। অর্থাৎ আবেদনের জন্য প্রকৃত সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০ কর্মদিবস! সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, আবেদনের শেষ তারিখ নির্ধারণ করেছেন সরকারি ছুটির দিনকে!
ভিসি তার একক সিদ্ধান্তে সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়া MPQ (Minimum Prescribed Qualification) এর কোন শর্তাবলী শিথিল করতে পারেন না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৭ নং শর্তাবলীতে বলা হয়েছে “অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য”। কিন্তু সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখার ০১/১২/২০০৪ খ্রি. তারিখের পরিপত্র অনুযায়ী “চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর বয়সসীমা কেন্দ্রীয়ভাবে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রার্থীর বয়সসীমা প্রমার্জনের কোন বিধিগত সুযোগ নেই”। এক্ষেত্রে উক্ত পরিপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কর্তৃক সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ভিসির সাথে বিশেষ সুসম্পর্কের খাতিরে জাকিয়া সুলতানা ২০২১ এর আগস্ট মাসে এড-হক ভিত্তিতে নিয়োগ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক ৬ মাস করে ২ বার অর্থাৎ ১ বছর মেয়াদবৃদ্ধির পর আর সুযোগ না থাকায় ১ দিনের সার্ভিস গ্যাপ দিয়ে পুনরায় তাকে আবারও এড-হক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ০৮-০৮-২০২২ তারিখে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ঐ বছরের ডিসেম্বরে তাকে স্থায়ীভাবে যোগদান করানো হয়। বিধিবর্হিভূত হওয়ায় তৎকালীন সময়ে উক্ত ১ দিনের সার্ভিস গ্যাপটি ব্রিজ করানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে জাকিয়া সুলতানাকে সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদে নিয়োগের লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেট সভায় পূর্বের সার্ভিস গ্যাপটি ব্রিজের অনুমোদন নেওয়া হয়।
তার স্থায়ী নিয়োগ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত হিসাব করলে তাঁর অভিজ্ঞতা দাড়ায় সর্বসাকুল্যে ২ বছর ৪ মাস! ৯ম গ্রেডের চাকরিতে ৪ বছর মেয়াদকাল ছাড়া কোনভাবেই তিনি ৭ম গ্রেডের পদে আবেদন করতে পারেন না।...
এছাড়াও জাতীয় পে স্কেল-২০১৫ (Public Bodies & Autonomous) এর অনুচ্ছেদ-১২ অনুযায়ী ৭ম গ্রেডের বেতন পেতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই কমপক্ষে ৪ বছর যাবৎ ৯ম বা তদূর্ধ্ব গ্রেডের চাকরিতে নিয়োজিত থাকতে হবে (সরাসরি বা পদোন্নতি যেভাবেই নিয়োগ প্রদান হোক না কেন)। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উক্ত বেতন আদেশও অমান্য করা হয়েছে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, MPQ তেও বলা হয়েছে উক্ত পদে নিয়োগের জন্য ৪ বছরের অভিজ্ঞতা আবশ্যক। অর্থাৎ বিশেষ সুসম্পর্কের খাতিরে এই একজন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে তিনি ২০০৪ সালে জারিকৃত সরকারের পরিপত্র, জাতীয় বেতন আদেশ-২০১৫ এবং MPQ -এই তিনটি বিধানই ভঙ্গ করেছেন।
এছাড়া সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত সংবিধি-১ অনুযায়ী ৭ম গ্রেডের নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচনী বোর্ডের সুস্পষ্ট পদবিন্যাস রয়েছে। কিন্ত উপাচার্য আশীর্বাদপুষ্ট রেজিস্ট্রার এবং ট্রেজারারের যোগসাজশে উক্ত বিন্যাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে উপাচার্যের একাধিক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস.এম মাহবুবর রহমান, সিন্ডিকেট সদস্য ইউসুফ হারুন প্রমুখ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচনী বোর্ড গঠন করেন। কিন্তু সংবিধি অনুযায়ী উক্ত নির্বাচনী বোর্ডটি সম্পূর্ণ অবৈধ।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালযের সংবিধি অনুযায়ী নিয়োগ কমিটির এক্সপার্ট মেম্বার হিসেবে যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) কে রাখার ট্রাডিশন থাকলেও অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের জন্য ওজোপাডিকোর একজন রিটায়ার্ড পরিচালককে ভিসি নিয়োগ কমিটিতে রেখেছেন, যিনি ভিসিরই সাবেক ক্লাস ফ্রেন্ড এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু! এছাড়া দ্রুত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নিয়োগ কমিটিতে তিনি নিজের পছন্দের লোকদেরকেই রেখেছেন।
এতো কিছুর পরেও নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সুপারিশ অনুযায়ী অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে আবেদনের জন্য ন্যূনতম অভিজ্ঞতাই নাই, সেই প্রার্থীকে (জাকিয়া সুলতানাকে) উক্ত পদের নিয়োগপত্র দেওয়ার পায়তারা চালাচ্ছেন ভিসি ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান।
এছাড়া, নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য স্বীকার করেছেন যে অধিকাংশ সময় সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার কোন সুযোগ না দিয়ে প্রায় সব সিদ্ধান্ত ভিসি একাই নেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ০৩ মার্চ ভিসি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদত্যাগে দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন চিকিৎসক সমাজ ও খুলনাবাসী। উক্ত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন বিএমএ’র সাবেক সভাপতি ডা. রফিকুল ইসলাম বাবুল, নাগরিক নেতা ও সাংবাদিক রকিবুল ইসলাম মতি, চিকিৎসক নেতা ও ড্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. এস এম আকরামুজ্জামান, খুলনা স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এনামুল কবির, ডা. বাপ্পি, ডা. আমান প্রমুখ। পরদিন অর্থাৎ ০৪ মার্চ তার পদত্যাগের দাবিতে স্থানীয় সচেতন জনগণ মানববন্ধনসহ ঝাড়ু মিছিলও করেছেন। এতো কিছুর পরও ক্ষমতার চেয়ার থেকে একচুল সরানো যায়নি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী ভিসি ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমানকে। হাসিনাকে গদি থেকে নামানো গেলেও নামানো যায় নি তার এই দোসরকে! সম্ভবত হাসিনার চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর ভিসি ডাঃ মাহবুবুর রহমান!!!