
টানা ১৭ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই সাথে রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি- মন্ত্রী থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃবৃন্দগন। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে বিকল করেছে দেশের অর্থনীতির চাকা।
শুধু এমপি-মন্ত্রী নয়। আ’লীগ ও আ’লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর তকমা লাগিয়ে এই ১৭ বছরে অনেকেই গড়েছেন পাহাড় সম সম্পদ। ২০২৪ এর ৫ ই আগস্ট দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দরা পলাতক থাকলেও, অদৃশ্য ক্ষমতা বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুলনা মহানগর কৃষক লীগ নেতা গোপাল বিশ্বাস। খুলনা মহানগর যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশের একান্ত সহযোগী তিনি। শফিকুর রহমান পলাশসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার স্বর্ণ সিন্ডিকেট, টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ মজুদ করতেন এই গোপাল বিশ্বাস।
মজুদ অর্থ কৌশলে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করতেন তিনি। রূপসা মাছ বাজার সহ বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি করেছেন এক সিন্ডিকেট। রাতারাতি হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, অর্থ পাচার, হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করছে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তবে, কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ডেভিল খ্যাত এই গোপাল বিশ্বাস কে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না! তা নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা।
গোপাল বিশ্বাসের বাবার নাম ছুটে বিশ্বাস। তার গ্রামের বাড়ি রূপসা উপজেলার সেনের বাজারে। সেখানে রয়েছে নজরকাড়া পাঁচতলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি। অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালের খুলনা শিপইয়ার্ডেও দুইটি বিলাস বহুল বাড়ি রয়েছে। ঘরে রয়েছে রাজকীয় ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার। ফিশিং জাহাজ রয়েছে দুইটি। যার এক একটির মূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা। নামে ও বেনামে মালবাহী ট্রাক রয়েছে প্রায় দশটি। এ সকল ট্রাকে মালামাল সরবরাহের নামে সীমান্তে পাচার করা হয় স্বর্ণ।
গোপালের শ্বশুরবাড়ি সাতক্ষীরা সদরের বিডিআর ক্যাম্পের বিপরীত পাশে। সেখানে নামে ও বেনাম রয়েছে তিন বিঘা জমি। যার আনুমানিক মূল্য ২৫ কোটি টাকা। যশোরের বাঁকড়ায় প্রায় ৪০০ বিঘা মাছের ঘের রয়েছে। তিনি হোন্ডা ভেজেল নামক একটি ব্যক্তিগত আলিশান গাড়িতে চড়েন।
শুধু দেশে নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের হাওড়াতে রয়েছে তার নিজস্ব বিশাল মাছের আড়ৎ । বাংলাদেশ থেকে ভারতে টাকা পাচার করে গড়েছেন দ্বিতীয় সাম্রাজ্য। সেখানেও প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার।
এছাড়া খুলনার বিএনপি নেতা আমির হোসেন বোয়িং মোল্লা(৬০) হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযোগের তীর এখন গোপাল বিশ্বাসের দিকে। নিহত বোয়িং মোল্লার স্বজনদের তথ্য মতে এই হত্যাকাণ্ডের অর্থের যোগান ও হুকুমদাতা গোপাল। ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর, বুধবার সন্ত্রাসীদের হামলায় খুলনা বিএনপির নেতা আমির হোসেন বোয়িং মোল্লা (৬০) আহত অবস্থায় কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর মারা যান ।
মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পূর্বে নগরীর টুটপাড়া তালতলা থেকে বাসায় ফেরার সময় সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি শরীরে না লাগায় সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার মাথা ও ঘাড়ে একাধিক আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, বোয়িং মোল্লা একজন বয়স্ক ও ধার্মিক লোক ছিলেন। তার সাথে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের ঝামেলা ছিল না। আওয়ামী লীগের পোস্টধারী কিছু ব্যক্তি রূপসা বাজারে রূপচাঁদা মাছের সিন্ডিকেট চালাতো। ৫ ই আগস্টের পর সেই সিন্ডিকেট ভেঙে যায়। সে সময় রূপচাঁদা মাছের এই সিন্ডিকেটের দায়িত্ব নেয় বিএনপি নেতা বোয়িং মোল্লা। ফলে সন্ত্রাসীদেরকে টাকা তাকে দিয়ে হত্যা করা হয়।..
নিহত বোয়িং মোল্লার এক নিকট আত্মীয় জানান, “রূপসা মৎস্য আড়তের রূপচাঁদা সিন্ডিকেটের গডফাদার ছিলেন গোপাল বিশ্বাস। প্রতি কেজি রূপচাঁদায় ২০০ টাকা করে টাকা নিতেন গোপাল। ৫ ই আগস্টের পর রূপচাদা সিন্ডিকেট টি দখলে নেয় বোয়িং মোল্লা। কোটি টাকার সিন্ডিকেট হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায়, দীর্ঘ তিন মাস ধরে বোয়িং মোল্লাকে হত্যার ছক আকে গোপাল। অবশেষে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়।…
হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড গোপাল হলেও, কোন প্রমাণ রাখেনি। কিলিং মিশনের ক’দিন আগেই পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। বোয়িং মোল্লার হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দেওয়ার পর দেশে ফেরেন গোপাল। আওয়ামী সরকারের পতন হলেও, সেই থেকে বহাল তবিয়াতে রয়েছেন গোপাল বিশ্বাস। সম্প্রতি গোপাল বিশ্বাস কে সন্দেহভাজন হিসেবে আনা হয় কেএমপি ডিবির কার্যালয়ে। এ সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে পাসপোর্টে ভারত যাওয়ার ইমিগ্রেশন সিল দেখান।...
অভিযোগের তীর তার দিকে থাকলেও তথ্য ও প্রমাণ ছাড়া আটক করতে ব্যর্থ হয় ডিবি পুলিশ। তবে এখানেই শেষ নয়, তদন্তে গোপাল এর নাম উঠে আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান কেএমপির গোয়েন্দা বিভাগের(ডিবি) উপ-কমিশনার মো: তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, নিহত বোয়িং মোল্লা হত্যাকাণ্ডের সন্দেহের তালিকায় থাকায় গোপালকে ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু, হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ভারতে ছিলেন। তার পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ ও বাংলাদেশে ফেরার প্রমাণ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলছে। সম্পৃক্ততা পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে অল্প দিনের ব্যবধানে পাহাড়সম সম্পদ ও অর্থের মালিক বনে যাওয়া গোপাল বিশ্বাসের নাম হত্যাকাণ্ডে জড়ানোর পর সমালোচনা চলছে সর্বত্র। আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক এর সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান শুভ্র বলেন, সুস্পষ্ট তথ্য ও প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমে ফাইল ঢাকায় পাঠানো হয়। পরবর্তীতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।