খুলনাঞ্চলবাংলাদেশ

খুলনায় রেলের ২৩০ বিঘা জমি বেদখল

#সিংহভাগ প্রভাবশালীদের দখলে

#উদ্ধারে নেই কোন উদ্যোগ

#দখলকৃত জমিতে তৈরি করা হয়েছে সেমিপাকা, পাকা আবার কোথাও দ্বিতল ভবন

#অবৈধ দখলদারদের তথ্য থাকলেও উচ্ছেদ নেই।

দেশ বাংলা নিউজ ঃ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ রেলওয়ের বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে দেশের অন্য জায়গায় জোর তৎপরতা দেখা গেলেও খুলনায় তা তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। যেসব জমি দখল করে স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে গেছে সেই কবে; কিন্তু এখনো জমি উদ্ধারে কোনো ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে দেখা যায়নি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় থাকা খুলনা জেলা রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তাদের। তবে রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেলের বেদখলকৃত জমি উদ্ধারের এটাই মোক্ষম সময়। যেহেতু বর্তমান সময়টা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, সেহেতু এই সময়ে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করা অনেকটাই সহজ হবে। অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে লোকদেখানো দুই-একটা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। যে কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে দায়িত্বহীনতার প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ। আরও অভিযোগ রয়েছে, বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তার পেছনে রয়েছে দুর্নীতি। দখলবাজদের কাছ থেকে মাসিক কিংবা বাৎসরিক উৎকোচ গ্রহণ করতেই হাতছাড়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ভূমি সম্পত্তি। সরজমিনে দেখা গেছে, খুলনা জংশনে অবৈধভাবে দখলে রাখা জমিতে গড়ে উঠেছে সেমিপাকা, পাকা আবার কোথাও দ্বিতল ভবন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এমন অবৈধ স্থাপনা থাকলেও এ নিয়ে মাথাব্যাথা নেই তাদের। রেলওয়ের দেয়া তথ্যমতে, খুলনা জংশনে বেদখল থাকা জমিতে ১০৪ টি সেমিপাকা, পাকা, দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ের হিসাবমতে যার সরকারি আর্থিক মূল্য ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। নথিতে অবৈধ দখলদারদের নাম ঠিকানা সব তথ্য থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়না। জেলা ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, খুলনা কার্যালয় থেকে ২০১৯ সালে হালনাগাদ করা একটি তথ্য বিবরণী থেকে জানা যায়, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল খুলনা জেলার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৪১৩.১৮ একর। যার মধ্যে অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করা হয় প্রায় ৪৬৪.৪ একর জমি। যেখানে বেদখল জমির পরিমাণ ৭৬.০৫ একর। কৃষি লাইসেন্সকৃত মোট জমির পরিমাণ ১৯৪.৯৪ একর। বাণিজ্যিক লাইসেন্সকৃত জমির পরিমাণ ১৬.৮৯ একর এবং মৎস্য চাষ জমির পরিমাণ ২১.৪৬ একর। নার্সারি জমির পরিমাণ ০.৬৯৫৯একর। অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৬১৫.৮২ একর। খুলনা রেলওয়ের আওতায় মোট ১৯ টি স্টেশন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেদখল থাকা স্টেশনগুলোর মধ্যে রুপসা স্টেশনে ১৩৩.৩৬ একরের মধ্যে ১৫.৩৬ একর, রুপসা মংলা ৬.৫০ একর, সামন্তসেনায় ৬২.১১ একরের মধ্যে ৬.৬০ একর, বাহিরদিয়ায় ৬২.১৪ একরের মধ্যে ৫.৮০ একর, কর্নপুর ২৫.৮৮ একরের মধ্যে৩.৫৫ একর, বাগেরহাট কলেজ স্টেশনে ৩১.৭৭ একরের মধ্যে ৪.১৩ একর, ষাটগম্বুজ ৩.৯৯ একর, তালতলার হাট ৩.৬৬ একর, শিরোমণি ৩.০৪ একর, দৌলতপুর ২.৫২ একর এবং খুলনা ও খুলনা জংশনে ৯.১৫ একর। দৌলতপর ও দৌলতপুর কলেজ স্টেশনের বেদখল হওয়া সম্পত্তির পরিমাণ ৩.৩২ একর। খুলনা রেলেওয়ের বেদখল জমির খুলনা ও খুলনা জংশনে রয়েছে ৯.১৫ একর। অবৈধভাবে দখলে রাখা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কেসিসি ০.৩৫৮৫ একর, বিআইডব্লিউটিসি ০.৭৪১৯ একর, যাতে বিআইডব্লিউটিসির পরিত্যক্ত অফিস ভবন রয়েছে। কেডিএ ০.৫৪৮০ একর, ফেরিঘাট বাস টার্মিনাল ১.০৩০ একর, খুলনা মটর বাস মালিক সমিতি ০.৪৮২০ি একর। খুলনা জংশনের বেদখল ৭.৫৬ একর জায়গার পুরোটাই দখলে কেসিসি’র। যেখানে বাৎসরিক গরুর হাট বসে। বেদখল জমিগুলো নিয়ে রেলওয়ে এবং দখলে থাকা কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে বছরের পর বছর চলছে মামলা। খুলনা রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় বেদখল হওয়া জমির পরিমাণ ৭৬.০৫ একর। এর মধ্যে খুলনা ও খুলনা জংশনে রয়েছে ৯.১৫ একর। বেদখল এসব জমির পুরোটাই সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে। অপদখলীয় অন্যান্য স্টেশনের জমির সিংহভাগই ব্যক্তি পর্যায়ে দখলে রয়েছে। এদিকে দৌলতপর ও দৌলতপুর কলেজ স্টেশনের বেদখল হওয়া সম্পত্তির পরিমাণ ৩.৩২ একর। বেদখল থাকা এ সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই প্রভাবশালীদের দখলে। দখলকৃত জমিতে সেমিপাকা, কোথাও পাকা আবার কোথাও দ্বিতল ভবন তৈরি করে করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন করা হয়েছে। প্রভাবশালীরা আবার এগুলো থেকে ভাড়া আদায় করে। খুলনা রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ সব কিছু জানার পরও কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। খুলনা রেলের পতিত জমির পরিমাণ ৬১৬ একর, যা রেলের কোন কাজেই ব্যবহৃত হয় না। পতিত এসব জমির বেশিরভাগই রয়েছে রুপসা মংলা স্টেশনে। সেখানে পতিত জমির পরিমাণ ২৬৪ একর। এছাড়া রুপসায় ৭০ একর, যাত্রাপুরে ৫৯ একর, খুলনা জংশনে ২৭ একর জমি পতিত হিসেবে রয়েছে। অন্যান্য স্টেশনগুলোতেও রয়েছে পতিত জমি। এসব জমিতেও গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। বেদখল হওয়া জমিগুলো উদ্ধারে রেলওয়ের দৃশ্যমান তেমন কোন উদ্যোগ নেই। বছরের পর বছর মামলা চলমান। মামলার মাধ্যমে কোন জমি উদ্ধার হয়েছে এমন কোন তথ্য খুলনা রেলওয়ের কাছে পাওয়া যায়নি। গত ২৪ ডিসেম্বর খুলনা রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ থেকে অবৈধভাবে দখলে রাখা রেলের সম্পত্তি ছেড়ে দিতে মাইকিং করা হয়, অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় এমন ঘোষণার পরও কোন বেদখল সম্পত্তি ছেড়ে দেয়নি কেই। বেধে দেয়া সময়সীমা অতিবাহিত হলেও কর্তৃপক্ষের কোন কঠোর পদক্ষেপও দেখা যায়নি।সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপিকা রমা রহমান বলেন, খুলনার উন্নয়নের স্বার্থে খুলনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ সকল সচেতন সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রেলের সম্পদ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, এটা বেদখলে থাকা মানে রাষ্ট্রের ক্ষতি। তাই রেলের সম্পত্তি উদ্ধারে সরকারের পাশাপাশি খুলনাবাসিকে আন্তরিক হতে হবে। জেলা ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা শাহিদুজ্জামান বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি, এখনো সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। রেলের বেদখল জমি উদ্ধারে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার পক্ষ থেকে মাইকিং করে দখল করে থাকা জমি ছেড়ে দেয়ার একটি নির্দেশনা পেয়েছি। কিন্তু এখনো প্রচার কাজটি করতে পারিনি। খুব দ্রুতই জমি ছেড়ে দিতে মাইকিং করা হবে।

বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল সক্রিয় এবং আন্তরিক দাবি করে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি নির্দেশনা পেয়েছি কিন্তু সতর্কতামূলক মাইকিং করা হয়নি। বেদখল সম্পত্তি উদ্ধারের আগে সেটার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে না পারলে উদ্ধাররের পর পুনঃদখল হয়ে যায়। তবে রেলের জমি দখল করে কেউ স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button